মিরসরাইয়ে অনাবাদি জমিতে কলাচাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা
দুই বছর আগে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন অলিনগর এলাকার জুলি আক্তারের স্বামী নুরুল আবছার। মৃত্যুকালে রেখে গেছেন নয়ন (১২), ইশান (৭) ও নিশান (২) নামে তিন সন্তান। অটোরিকশা চালক স্বামী বেঁচে থাকতে যা আয় করতেন তা দিয়ে তাদের সংসার চলে যেত।
স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েন জুলি। তার চোখে-মুখে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। দুবেলা তাদের খাবার জোগাড় করতে কষ্ট হয়। এরপর তিনি বাড়ির পাশের ১২ শতক জায়গায় গড়ে তোলেন কলা বাগান।
এতে একবছর পর ফলন আসে। এখন মোটামুটি ওই বাগানে উৎপাদিত কলা বিক্রি করে তিন ছেলে নিয়ে তার সংসার চলে যাচ্ছে। কলাচাষ জুলি আক্তারের তিন সন্তানের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। এভাবে কলাচাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন আরও অনেক কৃষক।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অনাবাদি জমিতে কলাচাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। অল্প খরচে লাভ বেশি হওয়ায় উপজেলার চাষিদের আগ্রহ বেড়েছে। অনেক কৃষকের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও এসেছে এ কলাচাষে।
কলার ফলন ও বাজার দর ভালো হওয়ায় হাসি ফুটছে কৃষকদের মুখে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় কলাচাষে শ্রম ব্যয় খুবই কম। জৈব সার ব্যবহার করে কলাচাষ করার ফলে স্থানীয় বাজারে এ কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভায় ১২৫ একর জমিতে কলা চাষ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর এলাকায়।
একাধিক চাষি জানান, যে জমিতে অন্য ফসল ভালো হয় না এবং জমি অনাবাদি থাকে সেসব জমিতে এখন কলাচাষ হচ্ছে। জৈব সার ব্যবহার করার কারণে এখানে ফলন ভালো হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভ বেশি এবং শ্রমিক খরচ কম, যার জন্য কলাচাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। কলাচাষের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত মাটি ও পরিবেশ।
সরেজমিনে গিয়ে উপজেলার অলিনগর এলাকায় গিয়ে কথা হয় একাধিক কলা চাষির সঙ্গে। ওই এলাকায় প্রথম কলাচাষ শুরু করেন মীর হোসেন মামুন নামে একজন। এরপর তিনি প্রবাসে চলে যান। তার দেখাদেখি কলাচাষ শুরু করেন ওই এলাকার খোরশেদ আলম মিন্টু, সোহেল, নবী সওদাগর, টিপু, মিজান, আফছার, সাহাব উদ্দিন সাবু, ইলিয়াছ, কবির হোসেন, সাহেদ, পারভেজ ও জুলি আক্তার।
মীর হোসেন মামুনের বাবা বেলায়েত হোসেন সিরাজ বলেন, ৬ থেকে ৭ বছর আগে ৬০ শতক জমিতে কলাচাষ শুরু করেন আমার মেঝ ছেলে মামুন। কিছুদিন পর সে কাতারে চলে যায়। এরপর থেকে আমি চাষ করে যাচ্ছি।
প্রথম প্রথম তেমন কলার ক্রেতা ছিল না। গত কয়েক বছর পাইকাররা জমিতে গিয়ে কলা কিনে থাকেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর পরপর নতুন করে চারা লাগানো লাগে। কলার পাশাপাশি কলা গাছের চারাও বিক্রি করেন। প্রতিপিস চারা ৩০ টাকা করে বিক্রি করা হয়।
খোরশেদ আলম মিন্টু নামে আরেক চাষি বলেন, আমাদের জমিতে বছরে একবার ধান হয়। আবার পানির অভাবে অনেক সময় ধান চাষ করা যায় না। তাই জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। তিন বছর আগে ৪০ শতক জায়গায় আমি কলা চাষ শুরু করেছি।
৪০ শতকে ৪৩০টি কলা চারা রোপণ করা হয়। একবছর পর গাছে ফলন আসে। এ পর্যন্ত আমি ৮০ হাজার টাকার কলা বিক্রি করেছি। আরও বিক্রি করতে পারব।
সোহেল নামে আরেক কলাচাষি বলেন, আমি ৩ বছর আগে ২৪ শতক জমিতে কলাচাষ করেছি। এর আগে জমিগুলো অনাবাদি পড়ে থাকত। একেবারে খালি পড়ে থাকার চেয়ে কলাচাষ করে যা আয় হচ্ছে তা অনেক ভালো। তিনি আরও বলেন, এখানকার কলার ভালো চাহিদা রয়েছে। কোনো ধরনের ফরামালিন ছাড়াই উৎপাদিত কলা বারইয়ারহাট, ফেনী, চট্টগ্রাম শহর থেকে পাইকাররা এসে নিয়ে যান।
স্বামীহারা জুলি আক্তার বলেন, দুই বছর আগে অসুস্থ হয়ে আমার স্বামী মারা যান। তখন আমার ছোট ছেলে নিশানের বয়স মাত্র ২১ দিন। ছেলেদের নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটে আমার। বাবার বাড়িও অনেক দূরে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। তাদেরও আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না, আমাকে কিভাবে সাহায্য করবে।
পরে আমার স্বামীর পৈতৃক ১২ শতক জায়গায় কলাচাষ শুরু করেছি। এখন সেই বাগানের উপৎপাদিত কলা বিক্রি করে মোটামুটি তিন সন্তান নিয়ে আমার চলে যাচ্ছে। বড় ছেলে নয়ন হোসেন ৫ম শ্রেণিতে পড়ছে। ২য় ছেলে ইশান প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। তবে কলা বিক্রির টাকায় চলতে হিমশিম খেতে হয়। তাই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো সহযোগিতা করলে আমার উপকার হত।
স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েন জুলি। তার চোখে-মুখে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। দুবেলা তাদের খাবার জোগাড় করতে কষ্ট হয়। এরপর বাড়ির পাশের ১২ শতক জায়গায় গড়ে তোলেন কলা বাগান।
করেরহাট ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোমিনুল হক বলেন, অলিনগরে কলাচাষ বেড়েছে। এখানে একজনের দেখাদেখি অনেকে কলাচাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আমরা কৃষি অফিস থেকে তাদের কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি।
উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কাজী নুরুল আলম বলেন, এই উপজেলায় ১২৫ একর জমিতে কলাচাষ হয়। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায়ও কলাচাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া দুটোই কলাচাষের জন্য বেশ উপযুক্ত। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় এ বছর কলার ভালো ফলন হয়েছে।
এমএমএফ/এমএস