ঝালকাঠিতে সবজি চাষে নারীদের সাফল্য

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝালকাঠি
প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ০৬ আগস্ট ২০২২

ঝালকাঠি শহর থেকে কীর্তিপাশার রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই বিখ্যাত ভীমরুলী বাজার। খালের পাড় ঘেঁষে ভীমরুলী ভাসমান বাজারে যেতে যেতে চোখ প্রশান্ত করবে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। যদিও এক সময়ের মেঠোপথ এখন পিচঢালা পাকা সড়কে রূপ নিয়েছে। ঝালকাঠি শহর থেকে মোটর সাইকেল, অটো রিকশা, মাহিন্দ্রা ও লেগুনা যোগে মাত্র ৩০ মিনিটেই পৌঁছা যায় ভীমরুলী বাজারে।

প্রতিদিন এখানে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকায় আসে বর্ষাকালীন সবজি। পেয়ারা রাজ্য খ্যাত এ এলাকায় শুধু পেয়ারা বা আমড়াই নয়, আছে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজিও। প্রায় ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ ভাসমান হাটে বর্ষা মৌসুমে যেমন পেয়ারা আসে সারি সারি নৌকায়, তেমনি নৌকা ভরে আসে বর্ষাকালীন শাক-সবজিও। এসব সবজি উৎপাদনে পুরুষের চেয়ে এখানকার নারীদের অবদান অনেক বেশি। পুরুষরা বাজারজাতকরণের কাজ করলেও মূলত উৎপাদনে প্রধান সহায়ক নারী।

ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৩৬টি গ্রামে এখন সারাবছর বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। মূলত শীত ও বর্ষাকালীন দুটি মৌসুমে সবজির উৎপাদন খুব বেশি হয়। অন্য সময়ে যা উৎপাদন হয় তা এদুটি সময়ের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। এ ৩৬ গ্রামে সবজি চাষে বিপ্লবে অবদান নারীদের। নারীদের এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে তাদের সাহায্যে পাশে থাকেন পুরুষরা। তারা বাজারজাতকরণ ও বেচা-বিক্রির কাজটিই বেশি করেন।

ঝালকাঠিতে সবজি চাষে নারীদের সাফল্য

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার এখন সবজি চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। এর মধ্যে উত্তরের বিনয়কাঠি, নবগ্রাম, কীর্ত্তিপাশা ও গাভারামচন্দ্রপুর এই ৪টি ইউনিয়নে সবজি চাষে ১৫টি গ্রাম বিশেষ অবস্থানে রয়েছে। এই চার ইউনিয়নে সারাবছরই সবজির চাষ হচ্ছে। শুধু নারীরাই এখানে মাঠে চাষবাস করেন। এই নারীদের সবজি চাষে উৎসাহ দেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগ সবসময়ই কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, সবজি ক্ষেতগুলো শসা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, কাকরোল, চাল কুমড়া, বেগুন, বরবটি, ঢ্যাঁড়শ, পুঁইশাক, লালশাক, ডাটাশাক, পাটশাক, করলাসহ বিভিন্ন সবজিতে ভরপুর। জেলায় দুটি নিরাপদ সবজি গ্রামও রয়েছে। সদর উপজেলার বিনয়কাঠি ইউনিয়নের মানপাশা ও নলছিটি উপজেলার বহরমপুর এই দুই গ্রামে চাষ হচ্ছে কীটনাশকমুক্ত সবজি। এখানে সবজি চাষে ব্যবহার হচ্ছে জৈব সার।

ঝালকাঠিতে সবজি চাষে নারীদের সাফল্য

কৃষি বিভাগ জানায়, সদর উপজেলায় বর্ষা মৌসুমে দেড় হাজার হেক্টর জমিতে সবজির চাষ হয়ে থাকে। এ মৌসুমে উৎপাদন হয় ২২ হাজার মেট্রিক টন।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সদর উপজেলার ৩৬ গ্রামে উৎপাদিত সবজি দিয়ে ঝালকাঠি জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা ও বরিশালসহ আরও কয়েকটি জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। পদ্মা সেতু হওয়ার সুবাদে ট্রাকে করে এসব সবজি চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। নারীদের এই বিপ্লব ঘটানো সবজি চাষের ফলেই মূলত সবজি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ঝালকাঠি জেলা।

ঝালকাঠিতে সবজি চাষে নারীদের সাফল্য

সবজি চাষের মধ্যে অন্যতম গ্রামগুলো হলো, ভীমরুলি, ডুমুরিয়া, বেশাইনখান, গোপীনাথকাঠি, শংকরধবল, খেজুরা, স্থানসিংহপুর, বেউখির, পাঁঞ্জিপুথিপাড়া, পূর্ব বাউকাঠি, মিরাকাঠি, বহারামপুর, দিয়াকুল, আতাকাঠি, পশ্চিম ভাওতিতা, দেউড়ি, রাজাপুর, নাগপাড়া, গৈয়া, জগদীশপুর, হিমান্দকাঠি, দাঁড়িয়াপুর, শিমুলেশ্বর, বাউকাঠি, শতদশকাঠি, বিকনা, কাপড়কাঠি, আতা, আটঘর, কাঁচাবালিয়া, রমজানকাঠি, দোগলচিড়া, বেতরা, বালিগোনা, শাখাকাঠি ও গাবখান।

সম্প্রতি কীত্তিপাশা, ভীমরুলি, ডুমুরিয়া, বাউকাঠি ও শতদশকাঠিসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সকালের দিকে সবজির ক্ষেতে নারীরাই কাজ করছেন। ক্ষেতের বিভিন্ন কাজে নারীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ সবজি তুলছেন, কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন।

ঝালকাঠিতে সবজি চাষে নারীদের সাফল্য

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামগুলোর উৎপাদিত শাক-সবজি জেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকা ও বরিশালে চালান হচ্ছে। গ্রাম ঘুরে ঘুরে পাইকারেরা খেত থেকে সবজি সংগ্রহ করে চালান করেন বড় বাজারে। আবার নৌকায় করে স্থানীয় ভীমরুলীসহ অন্যান্য আড়তে নিলে পাইকাররা সেখান থেকে কিনে নিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে নারীরাও হাটে সবজি বিক্রি করতে যান।

কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ডুমরিয়া গ্রামের কিষানী রীতা রানী মন্ডল বলেন, ‘আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাঠে কাজ করে সবজি ফলাই। ঘরের পুরুষরা এগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। আমাদের এখানকার উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে জেলার বাইরেও পাঠানো হয়।’

তিনি আরও বলেন, একসময় গ্রামের নারীরা এতো কাজ করতেন না। তখন পেয়ারা, নারকেল, সুপারি আর সামান্য ধান হতো। সে সময় প্রায় প্রতিটি ঘরেই অভাব ছিল। কিন্তু এখন নারীরা মাঠে কাজ করেন। এ কারণে প্রায় সারাবছর এসব গ্রামে সবজির চাষ হচ্ছে। অভাবও কমে গেছে।

ঝালকাঠিতে সবজি চাষে নারীদের সাফল্য

ডুমুরিয়া গ্রামের কৃষক পঙ্কজ বড়াল বলেন, কিষানীরা ক্ষেত সামলে আবার সংসারের রান্নাবান্নাসহ ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেন। অনেক সময় নৌকা বেয়ে সবজি বাজারে নিয়ে বিক্রিও করেন তারা। এত সব কাজে পুরুষরা পাশে থেকে সাহায্য করেন। পেয়ারা, আমড়াসহ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা।

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ি) উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সদর উপজেলার যেসব গ্রামে সবজি চাষ হয়, সেখানে আমরা কারিগরি সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অর্থনীতির অবস্থা আরও মজবুত করছে।

আতিকুর রহমান/এমএমএফ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।