রাবার তৈরি হয় যেভাবে
শেখ আনোয়ার
রাবারের ব্যাপারে মানুষ শুরু থেকেই উৎসুক ছিল। কারণ রাবার হলো ওয়াটার প্রুফ। পানি চোয়ায় না। টেনে লম্বা করা যায়। তাপে গলিয়ে যে কোনো আকৃতিতে পরিণত করা সম্ভব। প্রথমদিকে রাবার ব্যবহারে কতগুলো মৌলিক অসুবিধা ছিল। যেমন- ঠান্ডা আবহাওয়ায় রাবার শক্ত হয়ে সংকুচিত হয়। আবার গরমে গলে নরম আঠালো হয়ে যায়।
রাবার থেকে তৈরি জিনিস ২৪ ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করা যেত না। হাজার হাজার বছর ধরে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ বিভিন্ন আকারের রাবারের জিনিস তৈরি করতো। এর মধ্যে ছিল জুতা, বল, পানি ধারক পিপাসা নিবারনী আলখাল্লা ইত্যাদি।
রাবার পাওয়া যায়, রাবার গাছের রস থেকে। এ রস দেখতে সাদা। একদম দুধের মতো। রাবার গাছের সাদা কষ রাবারের মূল উপাদান। রাবারের এ কষকে বলা হয় সাদা সোনা। রাবার গাছ জন্মে পৃথিবীর নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে।
বাংলাদেশের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ভাটেরা, সাতগাঁও শাহজীবাজার ও রূপাইছড়া রাবার বাগান রয়েছে। রাবার গাছের কাণ্ড চেছে কাঠের অংশটি ছিলে দেয়া হয়। সেই চাছা অংশ থেকে রস টপ টপ করে পড়তে থাকে। দেখা যায় যে, চাছা অংশে যদি একটি কাঠি পুতে দেয়া হয়, তবে রস ফোঁটায় ফোঁটায় পরতে থাকে। রস এভাবে সংগ্রহ করাটিই উত্তম।
রাবার আবিষ্কার হওয়ার পর এবং তরল রাবারকে শক্ত করার পদ্ধতিও বের করে মানুষ। এদিকে শক্ত রাবারকে ইউরোপীয়রা পুনরায় তরলে পরিণত করার একটি উপায়ের কথা ভাবতে শুরু করে। ক’দিন আগেও ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট আলোকিত করার জন্য ব্যবহার করা হতো কয়লা গ্যাস। এর প্রধান উপজাত হলো ন্যাফথা।
ন্যাফতা শক্ত রাবারকে গলে দেয় এবং রাবারকে তরল করে। চার্লস স্যাকিনটোল দু’টুকরো কাপড়ের মাঝখানে তরল রাবারের দ্রবণ সেটে সে সময় সুন্দর রেইনকোট বানান। যদিও এই রেইনকোট খুব ভারি এবং শক্ত ছিলো। তবে এটিই হলো পৃথিবীর প্রথম রেইনকোট বা বর্ষাতি।
এই সময় লন্ডনে, টমাস হ্যানকক দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কিছু রাবার সংগ্রহ করেন। সে রাবার দিয়ে তিনি রাবার ব্যান্ড, দস্তানা, বুট জুতা ইত্যদির সম্প্রসারণ (ইলাস্টিক) অংশগুলো তৈরি করেন। তবে রাবার তাপে গরম করলে বা পুনরায় তরল করলে আগের যে শক্তি তা নষ্ট হয়ে যেতো এবং বিকৃত হতো তাড়াতাড়ি।
তাই রাবারকে অনেককাল পর্যন্ত নানাভাবে রদবদল করলেও কি করে শক্ত, মজবুত, মসৃণ, সম্প্রসারণশীল, আঠালো, অর্থাৎ এর স্বাভাবিক গুণাবলী অক্ষুণ্ন রাখা যায় এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হলো।
আমেরিকায় ওভারশু প্রচলন হবার পর আমাজানের ভারতীয়রা ওইসব ওভারশু তৈরি করে রফতানি করতো। খুব শিগগিরই পানি নিরোধী কোট, জীবন রক্ষাকারী টিউব, ওয়াগনের ঢাকনা, হোস পাইপ ইত্যাদিও রাবার দিয়ে তৈরি শুরু হলো। বাজার ছেয়ে গেলো রাবারের জিনিসে। তবে রাবার শক্ত হওয়া, আঠালো, চটচটে, বিশ্রী গন্ধ ইত্যাদি সমস্যা কিন্তু তখনো ছিলো।
গরম ঠান্ডায় রাবারের দোষগুলো কাটিয়ে নেয়ার উপায় বের করার চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে নানানজন করেছেন। চার্লস গুডইয়ার হলেন এদের মধ্যে সবচে সার্থক। গুডইয়ারের কথা বলবার আগে অন্যান্যদের কথা কিছু বলে নেয়া উচিত।
চার্লস গুডইয়ার নিউইয়র্কের এক দোকানে একদিন রাবারের তৈরি লাইফ প্রিজারভার দেখেন। জিনিসটি তার খুব ভালো লাগলো। এটি আরো উন্নত করার জন্য উন্নতমানের একটি ভাল্ব তৈরি করে দোকানদারকে দেন। গুডইয়ারের আর্থিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। ভেবেছিলেন এ থেকে কিছু পয়সা পাবেন। কিন্তু দোকানদার গুডইয়ারকে বললো, রাবারই ভালো নয়, তো ভালো ভাল্ব দিয়ে কি হবে?
সেই থেকে শুরু। গুডইয়ার রাবার স্বাভাবিক গুণাবলি অক্ষুণ্ন রাখার কৌশল আবিষ্কারে মনোনিবেশ করলেন। রসায়নের কোনো জ্ঞান তার নেই। যন্ত্রপাতি সমন্ধেও কোনো ধারণা নেই। সবচে বেশি যা দরকার- টাকা। তাও নেই তার। তবু চললো গবেষণা।
পরবর্তী পাঁচ বছরে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। নানা রকম বাঁধা বিপত্তির পর নিজের একক প্রচেষ্টায় রাবার সমস্যার সমাধান করলেন। নিজের আবিষ্কারকে বললেন, মেটালিক গাম ইলাস্টিক। এটিই পরবর্তীকালে ভলকানাইজেশন নামে পরিচিত হয়। অগ্নিদেবতার নাম ভলকান। তার থেকেই এই নামের উৎপত্তি।
ভলকানাইজিং আবিষ্কার হবার পর রাবার থেকে বুট জুতা, কাপড়, ডাক্তারি যন্ত্রপাতি, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি ইত্যাদিসহ গাড়ির টায়ার সবই তৈরি সহজ হয়ে গেলো। সেই থেকে শুরু। এখনো গুডইয়ারের ভলকানইজড রাবার সেরা রাবার হিসেবে বিখ্যাত।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এমএমএফ/জেআইএম