পার্চিং পদ্ধতিতে ফসলের ক্ষতিকর পোকা তাড়ানোর উপায়

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৩৩ এএম, ২৫ অক্টোবর ২০২০

মনিরুজ্জামান কবির

বাঁশের কঞ্চি, গাছের ডাল, T- আকৃতির দণ্ড বা বাঁশের জটা প্রভৃতি খাড়াভাবে জমিতে পুঁতে পাখি বসার কিংবা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয় তাকে পাচিং (Perching) বলে। যে সমস্ত পাখি পার্চিং এ বসে তাদের পার্চিং বার্ড (Perching Bird) বলা হয়। পার্চিং বার্ডের পায়ে ৪টি লম্বা, পাতলা আঙ্গুল থাকে। এরমধ্যে ৩টি সম্মুখে এবং ১টি পিছনের দিকে থাকে যা পাখি তার ইচ্ছেমতো নড়াচড়া করতে পারে। এ সমস্ত পাখির পিছনে আঙ্গুল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কারণে তার উপর ভর করে স্বাধীনভাবে পার্চিং এ বসতে পারে।

পৃথিবীতে ৫৯ গ্রোত্রের ৫১০০ প্রজাতির পার্চিং বার্ড দেখা গেলেও এশিয়া মাহাদেশে ফিঙ্গে পাখি (Black drongo) ধানের পোকা মাকড় দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধানের জমির ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে পাচিং বেশ কার্যকরী। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালের প্রারম্ভে ধানচাষিদের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে পাচিংয়ের পরামর্শ প্রদান করা হয় (আলম, ১৯৬১)।

বর্তমানে ধানের জমিতে পোকামাকড় দমনে পাচিং একটি সফল কৃষকবান্ধব প্রযুক্তি। পাচিং করতে কৃষককে ধান চাষে অতিরিক্ত খরচ গুণতে হয় না। কৃষকের বাড়ির আঙ্গিনায় বা রাস্তার ধারে গাছের ডাল প্রাপ্তি সহজলভ্য বিধায় পাচিং পদ্ধতি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

jagonews24

যেভাবে পাচিং করবেন:
পাচিংয়ের জন্য কাষ্ঠল গাছের দু তিনটি শাখাসহ ডাল অথবা বাঁশের কঞ্চি কাটতে হবে। তারপর ডাল বা বাঁশের কঞ্চি থেকে পাতাগুলো ছাড়িয়ে নিতে হবে। চারা রোপণের ৩০-৪০ দিন পর জমিতে চারটি গোছার মাঝখানে খালি জায়গায় প্রতি ১০০ বর্গ মিটার (২.৫ শতক) জমির জন্য একটি ডাল অথবা বাঁশের কঞ্চি (হেক্টরে ১০০টি) মাটিতে পুঁতে দিতে হবে।

গাছের ডাল অথবা শাখাসহ বাঁশের কঞ্চি পুঁতার সময় খেয়াল রাখতে হবে উচ্চতা যেন গাছের পাতার শীর্ষ বিন্দু (ডিগ পাতা) থেকে কমপক্ষে ১০০ সেন্টিমিটার বা ১ মিটার হয়। এভাবে প্রতি হেক্টর জমিতে ১০০টি ডাল পুঁততে হবে। বাঁশের কঞ্চি বা শাখাসহ ডালের বিকল্প হিসেবে বাঁশের বাতা দিয়ে T-আকার তৈরি করে নিতে হবে। তবে জমিতে পার্চিং ব্যবহারের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, ব্যবহৃত ডালপালা পাখি বসার উপযুক্ত কিনা? অর্থাৎ ইহা শক্ত ও ধানগাছের চেয়ে বেশ উঁচু হতে হবে এবং পাখি যেন তার উপর সহজে ভর দিয়ে বসতে পারে এবং পোকা দেখতে ও ধরতে পারে।

উপকারিতা:
দিনের বেলায় ফিঙে, শ্যামা ও শালিক পাখি সাধারণত এসব ডালপালায় বসে খেয়াল করে ধান ক্ষেতের বা গাছের কোন অংশে পোঁকামাকড় ও তাদের মথ বেশি। সেদিকেই ড্রাইভ বা ঝাঁপ দিয়ে পোকা শিকার করে। তাছাড়া এ সমস্ত পোকাশিকারি পাখিগুলো ধান গাছের উপরে বাতাসের সমান্তরালে ভেসে ভেসে চোখ দিয়ে শিকার খোঁজে ও পোকা ধরে খায়। অন্যদিকে রাতের বেলায় লক্ষ্মী পেঁচা এই ডালে বসে ইঁদুর শিকার করে মাঠ ফসলে অবস্থানকারী ইঁদুরের সংখ্যা কমিয়ে দেয়।

গবেষণা ফলাফল:
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কীটতত্ত্ব বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পার্চিংকৃত জমিতে অবস্থানকারী পাখির খাদ্য থলিতে উপকারি পোকার চেয়ে অনিষ্টকারী পোকার সংখ্যা অনেক বেশি। পার্চিংয়ে ফিঙ্গে পাখি অন্যান্য পাখির তুলনায় বেশি বসে ও শিকার করে। ১৯৯২ সালে ব্রির কীটতত্ত্ব বিভাগের বিজ্ঞানী ড. জহিরুল ইসলাম ও এম ওয়াহিদুজ্জামান ১৯ টি ফিঙ্গের পেট চিড়ে পাকস্থলী পর্যবেক্ষণ করেন।

ফলাফলে দেখা গেছে, ফিঙ্গের পাকস্থলীতে ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড় ৪৯ ভাগ, উপকারি পোকামাকড় ৩৫ ভাগ ও অন্যান্য (নন রাইস অর্থাৎ ধানের কোন ক্ষতিকর বা উপকারী পোকামাকড় নয়) পোকামাকড় ১৬ ভাগ। একই বিভাগের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধান গাছের শীর্ষ পাতা (ডিগ পাতা) হতে ১০০ সেন্টিমিটার উঁচু এবং ১০০ বর্গমিটারে একটি ডাল (হেক্টরে ১০০ টি/ বিঘায় ১৬ টি) খুবই কার্ষকরী।

jagonews24

ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে ধানক্ষেতে গাছ বা বাঁশের ডালপালার পরিবর্তে ধৈঞ্চা গাছ (Live Perching) পার্চিং হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যা মোটেই বিজ্ঞান সম্মত নহে।

প্রথমত: একই মৌসুমে ধান গাছের সঙ্গে ধৈঞ্চা গাছ লাগানো হলে উক্ত গাছ পাখি বসার মত উপযোগী হয় না। দ্বিতীয়ত: কোথাও কোথাও ধান কাটার পরে ও ধৈঞ্চা গাছকে নষ্ট না করে কয়েক মৌসুম বাড়তে দেয়া হয় যাতে করে ধৈঞ্চাগাছের ডালপালা বৃদ্ধি পায় এবং পাখি বসার উপযোগী হয়। এমন অবস্থায় ধৈঞ্চা গাছের কিছু পাতা মাটিতে পড়ে অল্প কিছু জৈবসার যুক্ত হলেও এ পদ্ধতি ব্যবহার করা ঠিক নয়।

কারণ রাজশাহী অঞ্চলের পবা উপজেলায় ব্রি, কর্তৃক এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে বর্ধিত ধৈঞ্চা গাছের নিচের ধানক্ষেতে শিষের সংখ্যা শতকরা ৮-৯ ভাগ কমে যায় যা ধানের ফলনের উপর ঋণাত্বক প্রভাব ফেলে।

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধানক্ষেতে পোকা দমনের জন্য তথাকথিত লাইভ পার্চিং (ধৈঞ্চা গাছ) ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ এতে ধৈঞ্চা গাছ উৎপাদনের জন্য কৃষকের বাড়তি খরচের প্রয়োজন হয় এবং ফলন ও কমে যায় যা কোনভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

লেখক: র্ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলকি কার্যালয়, বরিশাল।
[email protected]

এমএমএফ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।