বেকারত্ব ঘোচাতে হলুদ সামার স্কোয়াশ চাষ

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৩৪ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

দেশের বিভিন্ন স্থানে সামার স্কোয়াশ চাষ করা হচ্ছে। যারা বেকারত্ব ঘোচাতে চান তারা সামার স্কোয়াশ চাষ করতে পারেন। এটি খুবই লাভজনক। সামার স্কোয়াশ চাষ কীভাবে করা যায়, চাষ করার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কিনা- এক বিঘা জমির উৎপাদন খরচ, এর পুষ্টিমান এবং সর্বোপরি এর মাধ্যমে কীভাবে বেশি আয় করা সম্ভব, সে বিষয়ে আগে জানতে হবে।

আমাদের দেশে প্রায় সব অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ করা হয়। শাকসবজির মধ্যে সামার স্কোয়াশ হচ্ছে অন্যতম। আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গায়ই মিষ্টি কুমড়া জন্মায় সেসব জায়গায় এই সামার স্কোয়াশ চাষ করা যায়। বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক স্থানে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সামার স্কোয়াশ চাষ প্রতি বছর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সামার স্কোয়াশে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ আছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য শাকসবজির ওপর নির্ভর করে। সামার স্কোয়াশ অনেকটা মিষ্টি কুমড়ার মতো; সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। এর পাতা ও কাণ্ড সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। সামার স্কোয়াশ চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করাও সম্ভব।

সামার স্কোয়াশ চাষ পদ্ধতি ও উৎপাদন কৌশল
চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু ও মাটির প্রকৃতি কেমন হতে হবে এবং কখন সামার স্কোয়াশ চাষ শুরু করতে হবে তা জানা খুবই জরুরি। সামার স্কোয়াশ শুধু বাংলাদেশের পরিবেশে শীতকালেই চাষ করা হয়। শীতকালীন চাষাবাদের জন্য ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) বীজ বপন করা হয়। আগাম শীতকালীন ফসলের জন্য ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ (আগস্ট মাসের মাঝামাঝি) থেকে সরাসরি বীজ বপন করা হয় জমিতে।

সামার স্কোয়াশ চাষের জন্য জমি তৈরি
ভালো ফলন পেতে হলে জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে।
মাটি ও জমির প্রকারভেদে ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে।
শীতকালীন চাষের সময় জমিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে প্রয়োজনে জমি চাষের আগে সেচ দিয়ে নিতে হবে।

বীজ বপন ও চারা রোপণ পদ্ধতি 
সামার স্কোয়াশ বীজ সরাসরি জমিতে রোপণ করা যায়। ছোট আকারের পলিথিন ব্যাগে চারা উৎপাদন করে বা প্লাস্টিক ট্রেতে তা জমিতে রোপণ করলে ভালো হয়।

এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ছোট সাইজের বীজ হলে ৩০ গ্রাম বীজ হবে। বড় সাইজের বীজ হলে ৫০০ গ্রামের মতো লাগতে পারে। বীজের আকার কোম্পানি কর্তৃক সরবরাহ করা বীজের ওপর নির্ভর করে।

বিজ বপন বা চারা রোপণ করার সময় গাছ থেকে গাছে দূরত্ব ১.৫ ফুট এবং একটি গাছের লাইন থেকে অন্য গাছের লাইনের দূরত্ব হলো ৩ ফুট। ৩৩ শতক জমিতে ২ হাজার ২০০’র মতো গাছ বসতে পারে।

সামার স্কোয়াশ চারা রোপণের ১০-১২ দিন আগে গর্তের মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে রাখতে হবে। জৈব সার বলতে পুরোনো পচা গোবর সার হতে পারে বা কেঁচো জৈব বা ভার্মি জৈব সার হতে পারে। বীজ বপন করার ১০-১৫ দিনের ভেতর চারা বের হয়ে গাছ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাবে।

কৃষকদের মতে, গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে সামার স্কোয়াশ চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে।

এছাড়া ভালো ফলন পেতে কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় কোনোভাবেই যেন বেশি জৈব সার বা গোবর সার না দেয়া হয়।

Skosh

সামার স্কয়াশের জন্য তৈরি প্রতিটি বেডে বা মাদায় নিম্ন তালিকা ও পরিমাণ মতো সার প্রয়োগ করা যাবে। টিএসপি ২ গ্রাম, ইউরিয়া ৮.৫ গ্রাম, এমপি ৬ গ্রাম, জিপসাম ৯ গ্রাম। 

সামার স্কোয়াশের জমিতে সেচ ও নিষ্কাশন পদ্ধতি 
সার দেয়ার পর হালকা সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। শীতকালীন চাষের জন্য এক মাস পর পর জমিতে সেচ দিতে হবে। সামার স্কোয়াশ চাষের সময় জমিতে পানি বেশি সময় জমতে দেয়া যাবে না।

সামার স্কোয়াশে রোগবালাই
সামার স্কোয়াশ ক্ষেতে মাছির আক্রমণ হয় বেশি, যেমন সাদা মাছি। এছাড়া জাব পোকার আক্রমণ হয়। সামার স্কোয়াশের পরিচিত রোগ হলো হুলু মোজাইক ভাইরাস এবং পাতা কুঁকড়ে যাওয়া। এই দুটি রোগ সাধারণত হয় সাদা মাছি বা জাব পোকার কারণে। যে জমিতে নিয়মিত সবজি জাতীয় ফসল, ভুট্টা জাতীয় ফসল নিয়মিত উৎপাদন হয়, সেখানে সাদা মাছির আক্রমণ অনেক বেশি হয়।

সামার স্কোয়াশে কিছু সমস্যা হলো ফুল বাঁকা হওয়া ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ। ফল পরিপুষ্ট হওয়ার আগে যদি ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করে ফল বাঁকা করে দেয় তাহলে খুব দুঃখজনক। ফলের মান ঠিকমত না হলে মালের কোনো মূল্য নেই।

সামার স্কোয়াশের রোগ প্রতিকার
মাছিপোকা দ্বারা যেসব ক্ষতি হতে পারে 
এই পোকা মিষ্টি কুমড়ার কচিফল ও ফুলের মধ্যে প্রথমে ডিম পাড়ে। পরে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফল-ফুলের ভেতর কুড়ে কুড়ে খায়। ফলে ফল ও ফুল পচন ধরে নষ্ট হয়ে যায়। এ পোকার আক্রমণের ফলে প্রায় ৫০-৭০ ভাগ ফল নষ্ট হয়ে যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা
আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে তা নষ্ট করে ফেলতে হবে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ।
সেক্স ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহার
মাছির আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার জন্য বিষটোপ অত্যন্ত কার্যকর।
রেড পামকিন বিটল

ক্ষতির ধরন
পামকিন বিটলের পূর্ণ বয়স্ক পোকা চারা গাছের পাতায় ফুটো করে এবং পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে। এ পোকা ফুল ও কচি ফলেও আক্রমণ করে।

দমন ব্যবস্থাপনা
চারা আক্রান্ত হলে হাত দিয়ে পূর্ণ বয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে এবং ক্ষেত সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।

জাবপোকা দ্বারা ক্ষতির ধরন
জাবপোকার আক্রমণে মিষ্টি কুমড়ার বাড়ন্ত ডগা ও পাতা হলুদ হয়ে যায়। গাছ তার সতেজতা হারিয়ে ফেলে এবং ফলন গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক জাবপোকা দলবদ্ধভাবে গাছের পাতার রস চুষে খায়। ফলে পাতা বিকৃত হয়ে যায়, বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও প্রায়শ নিচের দিকে কোঁকড়ানো দেখা যায়।

Skosh-1

মেঘলা, কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঠান্ডা আবহাওয়ায় জাবপোকার বংশ বৃদ্ধি বেশি হয়। প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হলে এদের সংখ্যা কমে যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা
প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাবপোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা যায়। নিমবীজের দ্রবণ বা সাবান গোলা পানি স্প্রে করলেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়। বন্ধু পোকাসমূহ সংরক্ষণ করলে এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কম হয়।

যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে 
চারা বের হওয়া থেকে পাঁচ দিন পর পর সাদা মাছি বা জাব পোকা দমনে কমপক্ষে ভালো নাম করা কোম্পানির দু-তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ ব্যবহার করুন। সেক্স ফেরো-মন ট্র্যাপ ও ইয়েলো সস্ত্রীকই কালার ট্র্যাপ ব্যবহার করতে হবে। ওষুধ ব্যবহার করলে অবশ্যই ভালো কোম্পানির ওষুধ ব্যবহার করা উচিত। ভাইরাস আক্রান্ত গাছ কোনো ধরনের ট্রিটমেন্ট না করে সরাসরি তুলে ফেলে গাছটি মাটি চাপা দিতে হবে।

সামার স্কোয়াশ চাষের সময় পরিচর্যা ও করণীয়
চাষের সময় মাটির ঢেলা ভেঙে দিতে হবে। গাছের বাউনি ও অন্যান্য যত্ন করতে হবে। জমিতে আগাছা জন্মাতে দেওয়া যাবে না। আগাছা জন্মালে তা নিড়ানির সাহায্যে তুলে ফেলতে হবে। কৃত্রিম পদ্ধতিতে পুরুষ ফুলের রেণু স্ত্রী ফুলের ওপর ছড়িয়ে দিলে উৎপাদন বাড়বে। গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা বের হয়। এগুলোকে শোষক শাখা বলে। শোষক শাখা গাছ বৃদ্ধিতে বাধা দেয় ও ফলন কমিয়ে দেয়। এগুলোকে ভেঙে দিতে হবে।

সামার স্কোয়াশ ফসল সংগ্রহ
সামার স্কোয়াশ পরিণত হলে গাছ থেকে তা সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত বীজ বপন বা চারা রোপণের ৩০ দিন থেকে ৪০ দিনের ভিতর গাছ থেকে ফুল এসে ফল ধরা শুরু হয়। সামার স্কোয়াশ বিভিন্ন রঙ ধারণ করে। ফলের বোঁটা খয়েরি রঙ ধারণ করে এবং গাছ মরতে শুরু করে।

সাধারণত স্কোয়াশের আদর্শগত মাপ হলো ৭০০-৮০০ গ্রাম বা ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি। বেশি বড় সাইজ করলে সবজি হিসেবে স্বাদ ও মান পরিবর্তন হয়ে যায়। ৫৫-৬০ দিনের ভেতর স্কোয়াশ বাজারজাত করা যায়।

উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ 
এক বিঘা জমি থেকে এক মৌসুমে ২২০০টি সামার স্কোয়াশ গাছ পাওয়া যায়। একটি গাছে গড়ে ১০ কেজি স্কোয়াশ হয়, যা এক বিঘায় প্রায় ২৪ হাজার কেজি। কোনো কোনো সময় ফলের সাইজের ওপর মোট উৎপাদন কম বেশি হবে।

মিজান/এসইউ/এএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।