করোনার কারণে পোল্ট্রি খামারে হাহাকার
করোনার প্রভাবে গাজীপুরে পোল্ট্রি শিল্পে চরম সংকট তৈরি হয়েছে। উৎপাদিত ডিম ও মাংসের উৎপাদন খরচ না ওঠায় প্রায় মাসখানেক ধরে লোকসান গুনছেন খামারিরা। কয়েক দিনেই ক্ষুদ্র খামারিরা সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এমনকি তারা পাশে পাচ্ছেন না কাউকে। গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় এমন হাহাকারের চিত্র দেখা গেছে।
গাজীপুর পোল্ট্রি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির তথ্যমতে, জেলার ৫টি উপজেলায় পোল্ট্রি খামার রয়েছে ৭ হাজার ২শ। এসব খামারের সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। খামারিদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের। তারা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে নিজেদের স্বর্বস্ব দিয়ে খামার পরিচালনা করলেও করোনা সংকটের সাথে আর পেরে উঠছেন না। অতীতেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় তারা সরকার থেকে তেমন প্রণোদনা পাননি। এখন পর্যন্ত খামারিরা সহায়তার কোনো নির্দেশনা পাননি। ফলে লোকসান দিয়েই খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন।
খামারিদের তথ্যমতে, বর্তমানে একটি ডিম উৎপাদনে একজন খামারির খরচ ৫ টাকা ৭০ পয়সা হলেও ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে ৪ টাকায়। আবার ১ কেজি বয়লার মাংস উৎপাদন খরচ ১শ টাকা হলেও বিক্রি করা হচ্ছে ৮০ টাকায়। উৎপাদন খরচের সাথে একদিকে যেমন উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না; তেমনি বিভিন্ন এলাকা লকডাউনে থাকায় ভোক্তা পর্যন্ত পণ্যের জোগান দেওয়া যাচ্ছে না। গাজীপুরে উৎপাদিত অধিকাংশ ডিম ও মাংস রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জে সরবরাহ হলেও সেখানে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভয়ে কেউ যেতে সাহস পাচ্ছেন না।
শ্রীপুরের নান্দিয়া সাঙ্গুন গ্রামের নাজমুল হক জানান, তিনি ধার-দেনা করে সাড়ে ৫ হাজার মুররির বাচ্চা তুলেছেন। শেডসহ তার সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। যখনই বিক্রির উপযুক্ত সময়; তখনই দেশে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। পরে তিনি ৪ লাখ টাকায় ওই মুরগি বিক্রি করেন। এতে তার লোকসান হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। এখন তো তার পথে বসার উপক্রম।
একই অবস্থা আবুল হাসেমের। তিনি জানান, তার এলাকায় ক্ষুদ্র খামার রয়েছে প্রায় অর্ধশত। এটাই তাদের একমাত্র সম্বল। করোনায় লোকসানে তিনিও ডিম উৎপাদনের মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। মুরগি বিক্রির টাকায় খাবারের টাকাই শোধ হয়নি। এখন শূন্য হাতে ঘরে খাবার পর্যন্ত নেই। এ সময় কাউকে পাশেও পাচ্ছেন না তারা।
কাওরাইদ গ্রামের তোতা মিয়া জানান, তার ১ হাজার মুরগি সবেমাত্র ডিম উৎপাদনে এসেছিল। কয়েক দিনের লোকসানে তিনি দেড়শ টাকা করে প্রতিটি মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। যদিও প্রতিটি মুরগির পেছনে তার খরচ হয়েছিল সাড়ে ৪শ টাকা। অবস্থা এমন যে, কয়েক মাস লোকসান দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। সব হারিয়ে এখন সরকারের খাদ্য সহায়তার পেছনে ঘুরছেন, যদিও তা মিলছে না।
পোল্ট্রি খামার মালিক সমিতির শ্রীপুর উপজেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মতিন জানান, শ্রীপুরেই রয়েছে ২ হাজার ৪শ খামার। গত কয়েক দিনের লোকসানে অর্ধেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। পথে বসেছে কয়েক হাজার লোক। বিভিন্ন সময় সরকারি প্রণোদনা এসব ক্ষুদ্র খামারি পর্যন্ত পৌঁছে না। প্রান্তিক এ খামারিদের বাঁচাতে দ্রুত সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তার।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সভাপতি খন্দকার মহসিন বলেন, ‘বর্তমানে করোনার প্রভাবে ভোক্তা পর্যন্ত উৎপাদিত পণ্য জোগান দেওয়া যাচ্ছে না। খামারি পর্যায়ে ডিম ও মাংস সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই প্রতিদিন লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে খামারিরা বিপর্যয়ে পড়েছেন। প্রান্তিক খামারিদের রক্ষায় সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করছি। অন্যথায় বিপর্যয়ে পড়বে পোল্ট্রি শিল্প।’
গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা দিপক রঞ্জন রায় বলেন, ‘গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পোল্ট্রি শিল্প অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু করোনার কারণে এখন অনেকটা দুঃসময় যাচ্ছে তাদের। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহায়তা করার মতো কোনো সরকারি সিদ্ধান্তের চিঠি এখনো আসেনি। তবে আমরা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি।’
শিহাব খান/এসইউ/জেআইএম