তিতাস নদী এখন মালোপাড়ার দুঃখ!

আজিজুল সঞ্চয়
আজিজুল সঞ্চয় আজিজুল সঞ্চয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া
প্রকাশিত: ০৬:০১ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯
ছবি: বাহাদুর আলম

নির্মল মল্লবর্মণ তিতাস নদীতে মাছ ধরছেন প্রায় ৫০ বছর ধরে। ভরা তিতাসে জাল ফেলে মাছ ধরতেন দলবেঁধে। বছর দশেক আগেও তার জালে ধরা পড়তো বড় বোয়াল, আইড়, চিংড়ি, পাবদা ও মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তখন এক সপ্তাহ জাল ফেলে যে মাছ ধরতেন; তা বিক্রি করেই ভালোভাবে এক মাস চলত তার সংসার। কিন্তু এখন আর নদীতে আগের মতো মাছ না পাওয়ায় কষ্টে দিন কাটছে তার। অনেকবার পেশা পরিবর্তন করার কথা ভাবলেও পূর্বপুরুষের পেশা হওয়ায় ছাড়তে পারেননি।

অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাসের কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ আর প্রাণভরা উচ্ছ্বাসের কথা বর্ণনা করেছিলেন। ফুটিয়ে তুলেছিলেন মালোপাড়ার জেলেদের জীবনযুদ্ধের চিত্র। কিন্তু তিতাসের সেই ভরা যৌবন আর নেই। দখল আর দূষণের ফলে দিন দিন জরাজীর্ণ খালে পরিণত হচ্ছে তিতাস। যে তিতাস মালোপাড়ার জেলেদের জীবনের সবকুটু জুড়ে; সেই তিতাসই এখন তাদের একমাত্র দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে! নদীতে আগের মতো মাছ নেই। যা আছে তা-ও কারেন্ট জাল এবং ঘের বানিয়ে আহরণ করছেন অন্য জেলেরা। এতে মানবেতর দিন কাটছে মালোপাড়ার জেলেদের। অনেকেই এখন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তাদের কেউ দর্জি, কেউ সেলুন, কেউ বা কাঠমিস্ত্রির কাজ করে দিনাতিপাত করছেন চরম কষ্টে।

Titas-in

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কয়েকটি উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে তিতাস নদী। ১০৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ ও ৩০ মিটার প্রস্থের এ তিতাস নদীতে মাছ ধরেই চলে মালোপাড়ার জেলেদের জীবন। আর শহরের গোকর্ণ ঘাট এলাকায় তিতাস নদীর পাড়েই মালোপাড়ার অবস্থান। মালোপাড়ায় ঢোকার পথেই রয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের আবক্ষ মূর্তি। বর্তমানে মালোপাড়ায় শতাধিক জেলে পরিবার বাস করছে। এরমধ্যে কেবল ২০-২৫টি পরিবার মাছ ধরা পেশায় যুক্ত রয়েছে।

একসময় নদীতে জাল ফেললেই ঝাঁকে-ঝাঁকে ধরা পড়তো নানা প্রজাতির মাছ। সেই মাছ বাজারে ভালো দামে বিক্রি করে চলত জেলে পরিবারগুলো। কিন্তু এখন আর আগের সেই চিত্র নেই। তিতাসের দুই পাড়ে অবৈধ দখল আর দূষণের কারণে দিন দিন জরাজীর্ণ খালে পরিণত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নদীটি। বাসা-বাড়ি ও হোটেলের বর্জ্য ফেলা হয় নদীর তীরে। আর প্রভাবশালীরা দখল করেছেন নদীর কূল। দীর্ঘদিন ধরে খননকাজ বন্ধ থাকায় পলি জমেছে। বর্তমানে খনন কাজ চললেও সেটি ধীরগতিতে চলছে।

Titas-in

এছাড়াও নদীর বিভিন্ন স্থানে চারপাশে বাঁশ পুতে শত শত ঘের বানানো হয়েছে। এই ঘের বানানোর ফলে পানি প্রবাহেও বাধা তৈরি হচ্ছে। এতে নদীতে অবাধ বিচরণের সুযোগ পাচ্ছে না মাছ। বড় হওয়ার আগেই কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরে ফেলেন মালোপাড়ার বাইরের জেলেরা। এতে আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। ঘেরের পাশে জাল ফেলতে গেলে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ মালোপাড়ার জেলেদের। এ নিয়ে প্রতিবাদ করারও সাহস নেই তাদের।

মালোপাড়ার বাসিন্দা নির্মল মল্লবর্মণ বলেন, ‘নদীতে মাছ ধরেই সংসার চলে আমার। মাছ বিক্রি করেই ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা শেখাচ্ছি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। ১০ বছর আগেও প্রচুর মাছ পেয়েছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। নদীতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো করে ঘের বানিয়ে এবং কারেন্ট জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরছে। ঘেরের সামনে আমাদের জেলেরা জাল ফেললেই বাধা দেওয়া হয়। এই ঘেরের কারণে মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ ঘের এলাকাটি চরের মতো হয়ে যায়। আমাদের দাবি থাকবে, নদীটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে আমাদের যেন নদীর সব জায়গায় মাছ ধরতে দেওয়া হয়।’

Titas-in

মালোপাড়ার বাসিন্দা নগীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ জানান, ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিতাস নদীতে মাছ ধরেন তিনি। মাছ বিক্রি করেই চলে তার সাত সদস্যের পরিবার। আগে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। সেই মাছ বিক্রি করে সংসার ভালোভাবেই চলত। ১০-১৫ বছর আগেও নদীতে অনেক পানি ছিল। এখন দখলের কারণে শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। গত ৭-৮ বছর ধরে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। কারণ মাছ বড় হওয়ার সুযোগই দেওয়া হয় না। মালোপাড়ার বাইরের জেলেরা নদীতে ঘের বানিয়ে মাছ ধরে। তারা জাল ফেলতে গেলে বাধা দিয়ে গালিগালাজ করে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস নেই তাদের। তিতাস নদীতে এখন তাদের দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নেই।

দুঃখ করে মালোপাড়ার বাসিন্দা সুকুমার বর্মণ বলেন, ‘১০-১৫ বছর নদীতে মাছ ধরেছি। এখন আর মাছ ধরি না। ঘের বানিয়ে অন্য জেলেরা এখন মাছ ধরে। আমাদের নদীর সব জায়গায় মাছ ধরতে দেওয়া হয় না। এক ঘের মালিক আমাকে মাছ ধরতে যাওয়ার পর গালিগালাজ করেছিল। এরপর থেকে মাছ ধরা ছেড়ে দিয়ে মাছের ব্যবসা শুরু করেছি।’

Titas-in

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিতাস নদী একটি উন্মুক্ত জলাশয়। এ উন্মুক্ত জলাশয়ে কাউকে ঘের বানিয়ে পানি প্রবাহ এবং মাছের অবাধ বিচরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। আমরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধ দখল এবং ঘেরগুলো উচ্ছেদ করছি। নতুন করে ঘের হয়ে থাকলে; সেগুলোও উচ্ছেদ করা হবে।’

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।