ফাঁসির অপেক্ষায় সোহাগপুরের বিধবারা
আমগোর পোলাপান বাপ ডাকপার পায় নাই এই কামরুজ্জামানের নাইগা (জন্য)। আমরা সোয়ামী আরাইয়া (হারিয়ে) বিদুফা (বিধবা) অইছি। মাইনসের (মানুষের) বাড়ি বাড়ি পাঁচটা পুনাই (বাচ্চা) নিয়া, ঘুরছি। ভিক্ষা কইরা খাইছি। অহন অর পুলাপানেরাও বাপ না থাহনের কষ্ট কিবা বুঝবো, ওর বউও বুঝবো বিদুফা (বিধবা) অইলে কিবা (কেমন) নাগে।
শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে একথা বলেন, সোহাগপুর বিধবাপল্লীর শহীদ হাতেম আলীর স্ত্রী অজুফা বেওয়া।
তিনি বলেন, সব শেষ তারপরেও কামরুজ্জামানেরে অহনাও (এখনো) ফাঁসির কাষ্টে ঝুলাইতাছেনা কে, বুঝবার পাইতাছিনা। আমরা ওর ফাঁসির অপেক্ষায় আছি। ফাঁসিডা অইয়া গেলে বুহের (বুকের) কষ্টডা কিছুডা জুড়াইতো।
শহীদ জসিমুদ্দিনের স্ত্রী নূরেমান বেওয়া বলেন, ওই সুময় ছোড ছোড তিন পুলা-মাইয়া নিয়া কতো কষ্ট করছি তার আর কওয়ন নাই। ঈদ-পরব আইলে মাইনষে পুলা মাইয়া নিয়া কতো আউস-আফিত্তি করে, উলামেলা (আনন্দ স্ফুর্তি) করে, কিন্তু বেডাইন না থাহনে কাইন্দা কাইন্দা চোক্কের পানি ফালানি ছাড়া কিছুই করা পাইনাই। ভিক্ষা করবার গেলেও মাইনষে দুর দুর কইরা খেদাই দিছে। ওহ! কি কষ্ট কবার সোমার (বলার শেষ) নাই। অহন কামরুজ্জামানের বউ-পুলাপানও আংগর নাহালা কষ্ট কিছুডা টের পাবো। আমরা অপেক্ষায় আছি, কহন ওরে ফাঁসিতে ঝুলান অবো। তহন কিছুডা অইলেও মুনে শান্তি নাগবো।
শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী অজুফা বেওয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, কামরুজ্জামানের ফাঁসটা অইলে বুহের থাইক্কা কষ্টের পাত্তরডা কিছুডা নামতো। কেরে অহনও ওরে ফাঁস দিতাছেনা, কিছুই বুঝা পাইতাছিনা।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বিধবারা কেবলই অপেক্ষার প্রহর গুণছেন কখন তারা শুনতে পাবেন কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের খবর।
৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুরে সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে গিয়ে শহীদ পরিবারের স্বজনদের সাথে কথা বললে এভাবেই তারা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানান।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল খাকার খবরে যে স্বস্তি তাদের মধ্যে ফিরে এসেছিলো, এখনও ফাঁসির রায় কার্যকর না হওয়ায় কিছুটা ক্ষোভ এবং আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে তাদের কণ্ঠে।
শহীদ ছফির উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন বলেন, কিয়ের লাইগা ফাঁসি কার্যকর অইতাছেনা, কিছুই বুঝতাছিনা। কামরুজ্জামানের ফাঁসিডা কার্যকরি অইলে শহীদদের আত্মাও শান্তি পাইতো, আমগর পরাণডাও জুড়াইতো।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই শেরপুর জেলা সদর থেকে ৪০ কি. মি. দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ মানুষকে হত্যা করে। নারীদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এর পর থেকে সোহাগপুর গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় বিধবাপল্লী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কামারজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কেবল সেই রায় কার্যকরের অপেক্ষা।
এমএএস/আরআইপি