চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা : ২১ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ড্রেনেজ প্ল্যান
জলাবদ্ধতা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হলেও নির্বাচনের পর কেউ এ নিয়ে বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। ফলে জনগণ থেকে নেয়া কর, বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার অনুদান ও স্থানীয় সরকারের বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা জল অপসারণের নামে লোপাট হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, অপচনশীল পলিথিন এবং খাল-নালা ভরাট। পলিথিনের ব্যবহার রোধ, ভরাট খাল-নালা উদ্ধারের পাশাপাশি ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করা না গেলে চট্টগ্রাম নগরীতে ১২ মাসই থাকবে জলাবদ্ধতা!
সিটি কর্পোরেশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মহানগরে জলাবদ্ধতার তিনটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নালা ও খাল বেদখল এবং নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার রোধে প্রশাসনিক ব্যর্থতা। ফলে অতিবৃষ্টিতে কর্ণফুলী নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি চাক্তাই খাল, ডোম খাল, হিজড়া খাল, নয়া মির্জা খাল, শীতল ঝর্ণা খাল, বামুননয়া হাট খাল, গুলজার খাল, বীর্জা খাল, ইছান্যা খাল, মাইট্টা খাল, লালদিয়ার চর খাল, ত্রিপূরা খাল, নাছির খাল, গয়না ছড়া খাল, কাট্টলী খাল, চশমা খাল দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করে থাকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রাণাধীন এ ১৭টি খাল এক শ্রেণির খালখেকোর কবলে পড়ে এখন নালায় পরিণত হয়েছে।
নগরী মানচিত্রে খাল থাকলেও বাস্তবে অনেক খালের কোনো চিহ্ন নেই! ফলে ভারী বৃষ্টিপাত হলে পরিস্থিতি হয় ভয়াবহ। প্রবেশ করা জোয়ারের পানি ও বৃষ্টিপাত একাকার হয়ে যায়। এ পানি ভরাট ও বেদখল হওয়া খাল ও নালা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান চালিয়েও তাদেরঅপশক্তির কাছে যেন ধরাশায়ী সিটি কর্পোরেশন! রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতায় খাল ও নালা খেকোরা সব সময়ে থাকে শাস্তির বাইরে। কখনো কখনো কর্পোরেশন উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলেই এ সব নালা ও খালখেকোরা আদালত থেকে নিয়ে আসে স্থিতি আদেশ। এর সঙ্গে যোগ হয়, কর্পোরেশনের কতিপয় কর্মকর্তার ধীরে চলা আমলাতান্ত্রিক কৌশল এবং আইন কর্মকর্তাদের গাফেলতি।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় সম্প্রতি চট্টগ্রামের গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়েছেন নতুন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্দেশ্য করে মেয়র নাছির বলেন, আমি সাংবাদিক ভাইদের একটা কথা বলতে চাই, পত্রপত্রিকায় জলাবদ্ধতাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এটার শিকার আমরাও। আপনারা ঢাকার দিকে তাকান। শুধু ঢাকা কেন, পৃথিবীর অন্যান্য শহরের কথা একবার ভাবুন।
রোববার নগর মহিলা আওয়ামী লীগ কর্তৃক দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। জলাবদ্ধতাকে চট্টগ্রামের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হওয়া মেয়র বলেন, আমরা যারা হজ, ওমরাহ করতে সৌদিআরব যাই সৌদিআরবসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয়। অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এসব খবর সেখানকার জাতীয় কোন দৈনিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়না।
তিনি বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতার খবরও জাতীয় পত্রিকায় সেভাবে আসে না। শুধু চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা হলেই সেটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করা হয়। চট্টগ্রামের ব্যাপারে জাতীয় পত্রিকাগুলো এটা কেন করে আমি জানি না।
এদিকে চট্টগ্রাম শহরের ১৭টি খালের আশেপাশে বসবাসকারী লোকজন শুধু খাল ভরাট করে ভবন, দোকান তৈরি করে ক্ষান্ত হয়নি, পরিণত করেছে খালগুলোকে আর্বজনা ফেলার উপযুক্ত স্থানে। ফলে দিন দিন ভরাট হয়ে চাক্তাই খালসহ সব খাল ক্রমশ ছোট হয়ে নালায় রূপান্তর হয়েছে। এ ছাড়া দ্রুত নগরায়নের ফলে নগরীর অভ্যন্তরে বিদ্যমান জলাশয়, ডোবা, নালা, পুকুর ভরাট করে ফেলায় নগরীর রাস্তা ও নালা একাকার হয়ে গেছে। এতে বৃষ্টির পানি রাস্তা দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত (দুই বছর) জাতীয় পার্টির মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ (তিন বছর) পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন বিএনপির মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। এ দুইজন ছিলেন মনোনীত। নির্বাচিত মেয়র ছিলেন দুইজন। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১০ (১৭ বছর) পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত (৫ বছর) বিএনপির এম মনজুর আলম মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকার তৈরি করে চট্টগ্রামের নগরীর ‘ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান’। ওই প্ল্যানে তিনটি নতুন খাল খনন, নদী ও সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত খালের মুখে স্লইচ গেইট স্থাপন, বিলুপ্ত খাল পুনরুদ্ধার, বিদ্যমান খালগুলোকে গভীর ও প্রশস্থকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পেরিয়ে গেছে ২১ বছর বাস্তবায়ন হয়নি ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান।
ক্ষমতায় থাকা মেয়রগণ ঢাক-ডোল পিটিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে খাল ও নালা খননের নামে শুধু খালের ওপরের ময়লা পরিষ্কার করা হয়েছে! মাস্টার প্ল্যানের পর মনোনীত ও নির্বাচিত মেয়র বাস্তবায়ন দূরে থাক এটি পড়েও দেখেনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই মেয়রের অভিযোগ নদী ও সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত খালের মুখে স্লইচ গেইট নির্মাণের ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এসব খালের নিয়ন্ত্রক পানি উন্নয়ন বোর্ড হওয়ায় এ গুলোর সংরক্ষণ, পরিচর্যার পুরো দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নদী বিশেষজ্ঞ মনঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ১৯৯৫ সালের ডেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়া নগরীর জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। তিনি বলেন সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কোনো সমন্বয় নেই। এ ছাড়া নগরীতে জলাবদ্ধতার আরো একটি কারণ হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। যত্রতত্র ফেলা পলিথিন নালা এবং খালের পানি প্রবাহের মুখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, গতবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনসহ কর্পোরেশনের উন্নয়ন কাজে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিলেন। কিন্তু বরাদ্দ মেলেনি বলে অভিযোগ তার।
তিনি বলেন, জলাবদ্ধতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ছোটবড় অনেকগুলো খালের মাটি উত্তোলন করে পানিপ্রবাহ বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৬৩টি নতুন ডাম্প ক্রয় করে জলাবদ্ধতা নিরসনেরর কাজ করেছেন। যেসব স্থানে স্কেভেটর নেয়া সম্ভব হয়নি সেখানে বয়ার সাহায্য স্কেভেটর ভাসিয়ে কাজ করা হয়েছে।
বিএ/এমএস