ওয়ালশের বিশালতায় হারিয়ে যাবেন না তো হাথুরু!


প্রকাশিত: ০১:৩৪ পিএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

তার বোলিং কোচ হয়ে আসা নিয়ে রাজ্যের কথা বার্তা, হই চই। একমাত্র গর্ডন গ্রিনিজ যখন হেড কোচ হয়ে এসেছিলেন, তখন এমন সাড়া পড়েছিল। যদিও তখন বাংলাদেশের ক্রিকেট আজকের জায়গায় ছিল না।

বাংলাদেশ তখন আইসিসির সহযোগি সদস্য। টেস্ট খেলা বহুদুরে। আইসসি ট্রফি জিতে নিদেনপক্ষে রানার্সআপ কিংবা তৃতীয় হয়ে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে বিভোর। ১৯৯৭ সালের মার্চে আইসিসি ট্রফি খেলতে জাতীয় দল মালয়েশিয়া যাবার অল্প কিছু দিন আগে হেড কোচ হয়ে আসেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্বর্ণ সময়ের অন্যতম সেরা ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে ক’জন বিদেশি সাবেক ক্রিকেটার বিভিন্ন সময় কোচ হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের মধ্যে এখনো গর্ডন গ্রিনিজ সবার ওপরে। ওই ক্যারিবীয় ওপেনারের তারকা ইমেজ সবার চেয়ে বেশি।

ভারতের নামী অলাউন্ডার ও প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম রূপকার (১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সাথে সেমিফাইনাল ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ) মহিন্দর অমরনাথও বড় ক্রিকোঁর ছিলেন; কিন্তু তারকা খ্যাতিতে গ্রিনিজের পেছনে। এছাড়া মুদাসসর নজর কিংবা হিথ স্ট্রিকও বড় মাপের ক্রিকেটার। তবে তারকা খ্যাতি ও নাম-ডাকে গ্রিনিজ এবং অমরনাথের ধারে কাছে নেই।

এবার টিম বাংলাদেশের প্রশিক্ষক বহরে আরও এক বড় তারার অন্তর্ভূক্তি। মাশরাফি, রুবেল, তাসকিন ও মোস্তাফিজদের কোচ হয়ে আসছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার কোর্টনি ওয়ালশ। তাই ওয়ালশের নিযুক্তি নিয়েও অনেক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

এ হাই প্রোফাইল সাবেক ফাস্ট বোলারের শনিবারে রাজধানী ঢাকায় আসার খবর নিয়েও ক্রিকেট অনুরাগি, ভক্ত ও সমর্থক মহলে ইতোমধ্যে সাড়া পড়ে গেছে।

ক্যারিয়ারের স্বর্ণ সময় পিছনে ফেলে আসলেও সীমিত ওভারের ফরম্যাটে এখনো যিনি টিম বাংলাদেশের পেস ডিপার্টমেন্টকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, সেই মাশরাফি বিন মর্তুজাও মানছেন,  ‘বাংলাদেশের পেস বোলাররা একজন বিশ্ব মানের ফাস্ট বোলিং কোচ পাচ্ছেন। যার ছোঁয়া এবং পরিচর্যায় দেশের ফাস্ট বোলিং আরও সমৃদ্ধ ও ধারালো হয়ে উঠতে পারে।’

মাশরাফির অনুভব, ওয়ালশের কাছ থেকে শুধু পেস বোলিংয়ের নিগুঢ় তত্ত্ব, বিভিন্ন কৌশল, খুঁটি-নাটি কার্যকর পরামর্শই মিলবে না; ফাস্ট বোলাররা কিভাবে ইনজুরি মুক্ত থেকে ক্যারিয়ারকে দীর্ঘ করতে পারে- সে শিক্ষা এবং ধারনাও পাবে।

শুধু মাশরাফি নন। বাংলাদেশ দলের ভেতরে ও বাইরে এবং সারা দেশে অগনিত ভক্ত-সমর্থকের বিশ্বাস ও অনুভব, ওয়ালশের মত বড় মাপের ফাস্ট বোলারের সান্নিধ্যই অনেক বড় কিছু বাংলাদেশের বোলারদের জন্য।

টেস্টে যার প্রায় সোয়া পাঁচশো (৫১৯) উইকেট, তার শারীরিক উপস্থিতিই যে বাংলাদেশের পেসারদের জন্য সঞ্জীবনি সুধার মত কাজ করবে!

মাশরাফি তাই বলেছেন, ‘ওয়ালশকে কোচ হিসেবে পাওয়া, তার সাথে ড্রেসিং রুম শেয়ার করাই অনেক বড় অনুপ্রেরনা। যা শুধু ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলেই চলবে না। আমাদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোরও এক বিশাল টনিক হবে। মনে হবে, আমাদের মাথার ওপর এখন আছে কোর্টনি ওয়ালশের মত বিশাল মহিরুহুর ছায়া। আমাদের আর চিন্তা ও ভয় কি?’

এমন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ভক্ত ও সমর্থকদের মনেও। তারাও উদ্বেলিত। তাদের মাঝেও আশার স্বপ্ন- যাক এবার আমাদের পেস বোলিং ডিপার্টমেন্টটা ভাল না হয়েই যায় না; কিন্তু পাশাপাশি দৃঢ় শঙ্কার মত মনে আরেকটা প্রশ্ন কাটার মতও বিধছে সবার।

‘আচ্ছা ওয়ালশ আসার সময় পর্যন্ত কি হাথুরুসিংহে ঢাকা থেকে যেতে পারতেন না। তিনি আসার পরে না হয় যেতেন। ঈদের ছুটির তো আরও বেশ কিছুদিন বাকি!’
 
মানা গেল, হাথুরুর অস্ট্রেলিয়া যাবার প্রোগ্রাম আগেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু সেটা কী আর দু’দিন পিছিয়ে দেয়া যেত না? এমন প্রশ্নকে অসাঢ় ভাবার কোনই সুযোগ নেই।

কারণ অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নির্বাচকের পদ ছেড়ে বিসিবির প্রস্তাবে রাজী হয়ে টিম বাংলাদেশের বোলিং কোচ হয়েছেন কোর্টনি ওয়ালশ। অথচ ঢাকায় পা রেখে শুনবেন, তিনি আসার  ২৪ ঘন্টা আগে দেশ ছেড়েছেন হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।

এটা শুনে ও জেনে তার মনে কি নিশ্চয়  একটা খটকা লাগবে না যে, ‘সে কি আমি আসলাম! আর তিনিও ছুটিতে চলে গেলেন?’

তবে বোর্ড কর্তারা হয়ত বোঝাবেন, বলবেন, ‘নাহ আপনার নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়া এবং ঢাকায় আসা নিশ্চিত হবার আগেই হাথুরুর অস্ট্রেলিয়া যাবার কথা-বার্তা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি টিকিটও কনফার্ম হয়ে গিয়েছিল। তাই হাথুরু অস্ট্রেলিয়া ফিরে গেছেন। ক’দিন পর অস্ট্রেলিয়ায় তাসকিন ও আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষা। হাথুরু সেখানেও থাকবেন। তারপর ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরে জাতীয় দলের কোচিং পরিচালনা করবেন।’

বোর্ড কর্তারা এসবই বলবেন হয়তো বা। অমন কথায় হয়তো ওয়ালশ সাময়িকভাবে আশ্বস্তও হবেন, তবে এাঁও নিশ্চিত, শুরুতেই তার মনে একটা সংশয়ের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে যাবে।

এদিকে ক্রিকেট অঙ্গনে আরও একটি সংশয় মাখা প্রশ্ন উঁিক দিচ্ছে। কারো কারো সন্দেহ, হাথুরুসিংহে কী ওয়ালশের মত বিশাল ক্রিকেট ব্যক্তিত্বকে তার সহযোগি কোচিং স্টাফ হিসেবে মেনে নিতে পারবেন? নাকি হীনমন্যতায় ভুগবেন? যেভাবে ভুগেছিলেন ট্রেভর চ্যাপেলও?

ইতিহাস স্বাক্ষী দিচ্ছে, ২০০২ সালে ট্রেভর চ্যাপেল যখন বাংলাদেশের হেড কোচ, তখন পাকিস্তানের তথা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াঁদাদকে খন্ডকালীন ব্যাটিং কোচ হিসেবে আনা হয়েছিল। ট্রেভর চ্যাপেল প্রকাশ্যে জাভেদের আসার বিরোধিতা করেছিলেন তখন। একদিন জাতীয় দলের অনুশীলনের সময় বুয়েট মাঠে একে অন্যের সঙ্গে তারা দু’জন তর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে জাভেদ মিয়াঁদাদ সাত দিনের কোটা পুরণের আগেই দেশে ফিরে যান।

মানা যাচ্ছে, হাথুরু হয়তো এমন করবেন না। করার সুযোগও নেই। কারণ বোর্ডের চুক্তিতে পরিষ্কার বলা আছে, তার সাথে সহযোগি, ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংসহ আরও কোচিং স্টাফ কাজ করবেন। তারা সবাই যে হাথুরুর পছন্দের ও তার নিজের মনোনীত হতে হবে- এমন কথাও সেখানে লিখা নেই।

তবে সবার জানা, এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে যতগুলো সহযোগি কোচিং স্টাফ কাজ করছেন, তাদের বড় অংশ হাথুরুর প্রেসক্রিপশনেই রিক্রুট করা। রুয়ান কালপাগে, হিথ স্ট্রিক, ভিল্লাভারায়ন- সব তার পছন্দের। অধিকাংশই তার দেশের। এমনকি খুব শিগগিরই যে খন্ডকালিন ব্যাটিং পরমর্শক হয়ে আসবেন, সেই সামারাভীরাও একজন শ্রীলঙ্কান।

আর সেখানে ওয়ালশ একজন ক্যারিবীয়। তাকে কিভাবে গ্রহণ করবেন হাথুরু? তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ, ভিতরের খবর, হাথুরু চেয়েছিলেন তার স্বদেশী চামিন্দা ভাস কিংবা চাম্পাকা রামানায়েকের কাউকে পেস বোলিং কোচ হিসেবে নিয়ে আসতে।

কিন্তু বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন প্রথম থেকেই একজন হাই প্রোফাইল ও বিশ্বমানের কোন সাবেক ফাস্ট বোলারকে কোচ হিসেবে পেতে আগ্রহী ছিলেন। তার প্রথম টার্গেট ছিলো পাকিস্তানের আকিব জাভেদ। টু-ডব্লিউ ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুসের ছায়ায় ঢাকা থাকলেও আকিবের নিখুঁত লাইন-লেন্থ ও সুইংয়ের প্রশংসা সবার মুখে মুখে। তাকে কোচ হিসেবে পেলে আমাদের পেসারদের লাভ হবে। এই ভেবেই আকিবের দিকে হাত বাড়ানো; কিন্তু তিনি আসতে না চাওয়ায় বিসিবি বিগ বস ঝুঁকে পড়েন ওয়ালশ, ডোনাল্ড ও অ্যামব্রোসের দিকে।

এ তিনজনই বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার। অনেক বড় তারকা। এ তিনজনের একজন- ওয়ালশই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ। যিনি তারকাখ্যাতি, অর্জণ ও কীর্তিতে হাথুরুর চেয়ে অনেক অনেক বড়।

শুধু তাই নয়; হয়ত বেতন-ভাতা ও আনুসাঙ্গিক সুযোগ সুবিধাও ওয়ালশ ভোগ করবেন বেশি। তার প্রতি বোর্ড কর্তাদের মনোযোগটাও থাকবে তুলনামুলক বেশি। আর ক্রিকেট অন্তঃপ্রান বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমের দৃষ্টি ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে যাবেন ওয়ালশ।

এসব বিষয় কি হাথুরু মন থেকে গ্রহণ করতে পারবেন? প্রায় দু ’বছর একা রাজত্ব করার পর তার চেয়ে নামী কারো অংশিদারিত্ব সহজে মেনে নেবার ইতিবাচক ও উদার মানসিকতা কি হাথুরুর আছে?

যদি তিনি তা নিতে না পারেন, তাহলে কিন্তু ক্ষতিই হবে। তখন ওয়ালশের মত বিশ্বমানের বোলারকে কোচ করে আনার কৃতিত্বটা মাটি হয়ে যাবে। বোর্ড সভাপতি তথা বিসিবি শুরু থেকেই হাই প্রোফাইল ওয়ালশ আর হাথুরুর বন্ধনটা দৃঢ় করার উদ্যোগ নিলে হয়ত ওই সমস্যার বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব হবে। না হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটে জন্ম নেবে অনেক আগাছার।

এআরবি/আইএইচএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।