হাসি নেই বেনারসি পল্লীতে

বাঙালি নারীর পোশাকের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে শাড়ি। আর ঈদে যদি হয় বেনারসি শাড়ি, তাহলে তো কথাই নেই। ঐতিহ্যের কারণে এমনিতেই বেনারসি শাড়ির প্রতি নারীদের আকর্ষণ বেশি। তবে ঈদ আসতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকলেও খুব একটা জমে ওঠেনি রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লীর দোকানগুলো। কেনাকাটায় তেমন ভিড় নেই বিখ্যাত এই পল্লীতে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতীয় ভিসা সহজীকরণ করা ক্রেতা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ঈদের আগে ভারতীয় ভিসা ক্যাম্প করা হয়েছে। এ সুযোগে পাইকারি অনেক ক্রেতা পণ্য কিনতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত চলে গেছেন। এ জন্য এবারের ঈদ বাজারে মিরপুরের বিখ্যাত বেনারসি পল্লীতে ভিন্ন চিত্র। রমজানের আগে ক্রেতাদের ভিড় থাকলেও এখনো দেখা মেলছে না ঈদের আমেজ।
তবে এখনো আশা ছাড়েননি ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতাদের রুচি বোধেরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। কয়েক বছর আগে জর্জেট জাতীয় শাড়ির খুব চাহিদা থাকলেও এখন বিভিন্ন প্রকারের বেনারসি, কাতান, জামদানি শাড়ির কদর বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, বেনারসি পল্লীতে ২৫-৩০ প্রকারের বিভিন্ন নাম ও ডিজাইনের শাড়ি রয়েছে। এবারের ঈদে দেশি শাড়ির মধ্যে বেনারসি কাতান, বুটি কাতান, হাড্ডি কাতান, পিওর কাতান, সুতি ও বিভিন্ন প্রকারের জামদানি, দুপিয়ান সিল্ক, সানন্দা, গাদোয়ান, মাসলাইস কটন, জুটনেট, সুপারনেট, পুদনমা বা পাড় ছাড়া কাতান, অপেরাকাতান, টিস্যু কাতান, মিরপুর জামদানি, কোটাসিল্ক, কাঞ্জিবলনের চাহিদা বেশি।
এছাড়া ভারতীয় শাড়ির মধ্যে নেট শাড়ি, গুপি, কোকিলা দির কাতান, রেম্বো, কলাবেরির কদর বেশি। বেনারসি পল্লী হলেও এখানে থ্রি-পিস, প্রিন্টের শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, লেহেঙ্গা, সিল্ক আর সুতি শাড়িও পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
হানিফ সিল্কের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ বলেন, মোটামুটি ভালোই বিক্রি করছি আমরা। তবে অন্যান্য বছর এই সময়ে ক্রেতাদের ভিড়ে খাওয়ার সময় পেতাম না। আর এবার সে তুলনায় একটু কম।
কারণ হিসেবে তিনি জানান, ভারতীয় কিছু মানহীন শাড়ি আমাদের বাজার নষ্ট করছে। ওই শাড়িতে লাভ বেশি, কিন্তু সুতা ভালো না। ফলে ক্রেতারা কম দামে পেলেও প্রত্যাশা অনুসারে ব্যবহার করতে পারছেন না। এ জন্য আস্থা নষ্ট হচ্ছে। অনেকে এখন ভারতমুখী হয়ে পড়ছেন। এটাও ক্রেতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। তবে চলতি সপ্তাহে ক্রেতা সমাগম বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
ধানমন্ডি থেকে শাড়ি কিনতে আসা গৃহিণী আরিফা আক্তার পলি জাগো নিউজকে বলেন, বেনারসি শাড়ি অন্য শাড়ির চেয়ে হালকা, পরতে আরাম, যা এই গরমের মধ্যে খুবই উপযোগী। এছাড়া শাড়ির রং ও ডিজাইন সব সময়ের জন্য উপযোগী। একই সঙ্গে ঐতিহ্যের বিষয় তো আছেই।
এদিকে, মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মিরপুর-১০, ১১ ও ১২ মিলিয়ে মোট ২ হাজারের মতো কারখানা রয়েছে। আগে আরো বেশি ছিল। এছাড়া মিরপুর-১০-এ ১২০টি এবং মিরপুর-১১ ও ১২ মিলে আরো ৫০টির বেশি বেনারসির দোকান রয়েছে।
বেনারসি পল্লী দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দিয়া শাড়ির স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম জাগো নিউজকে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়া পর থেকে এই বেনারসি পল্লী সম্প্রসারিত হতে থাকলেও আশির দশক থেকে এটি ব্যাপকতা লাভ করে আজকের পর্যায়ে এসেছে। আগে এখানে কারখানা ছিল বেশি, দোকান ছিল কম। এখন দোকান বেড়েছে, কিন্তু কমেছে কারখানার সংখ্যা।
এদিকে, ঈদের কেনাকাটার সুবিধার্থে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত মার্কেট খোলা থাকছে। এছাড়া সার্বিক নিরাপত্তার জন্য বেনারসি পল্লীতে বসানো হয়েছে র্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প।
বেনারসির পল্লীর শাড়ির দামদর
মসলিন বেনারসি ৮ থেকে ১৭ হাজার টাকা, কাতান বেনারসি ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা, ব্রোকেট বেনারসি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, কার্পেট বেনারসি ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা, মসলিন ২-৩ হাজার টাকা, নেট জুট সাড়ে ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা, বিয়ের গর্জিয়াস শাড়ি ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা, সফট সিল্ক ৪ থেকে ৪২০০ টাকা, ঢাকাই জামদানি ৪ থেকে ৩০ হাজার টাকা, রেডি কোচা ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা, জুট হাফ সিল্ক আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া হানিকোট বেনারসি সাড়ে ৪ হাজার টাকা, রাজকোট বেনারসি ৫ হাজার টাকা, সুতি বালুচুরি ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা, টিস্যু জুট সিল্ক জামদানি ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা, পিয়ান ও খাদি বেনারসি ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা, কাঁথা স্ট্রিচ ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, টাঙ্গাইল সুতি জামদানি ১ থেকে ১৫ হাজার টাকা, মাসলাইস কাতান ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা, শাটিন বেনারসি ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর ভারতের বেনারস থেকে সাড়ে ৩০০ মুসলিম তাঁতি পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে আসে। আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও স্বাধীনতার পর এদের বেশির ভাগ পরিবার মিরপুরে আবাস গড়ে তোলে। তাদের হাত ধরে ছোট ছোট তাঁতগুলো এক সময় বিশাল বেনারসি পল্লী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এমএ/এমএমজেড/আরএস/এমএস