শিল্পকলা পদক পাচ্ছেন সুজেয় শ্যাম

শিল্পকলার নানা শাখায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১৩ সাল থেকে প্রবর্তন করা হয়েছে শিল্পকলা পদক। তারপর থেকেই প্রতি বছর ৭ গুণী ব্যক্তিত্বকে এই পদকে ভূষিত করা হয়। ধারাবাহিকতায় এবার তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত হচ্ছে এই পদক প্রদান অনুষ্ঠান।
এ উপলক্ষে বিস্তারিত জানাতে আজ মঙ্গলবার, ৩ মে রাজধানীস্থ সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় এক সাংবাদিক সম্মেলনের। সেখানে জানানো হয় এবারে যন্ত্র সংগীতে আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখে এর উন্নয়ন, প্রসার ও প্রচারে ভূমিকা রাখায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও বরেণ্য সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামকে শিল্পকলা পদক প্রদান করা হচ্ছে।
এছাড়াও ‘শিল্পকলা পদক-২০১৫’ পাচ্ছেন নৃত্যকলায় সালেহা চৌধুরী, লোকসংস্কৃতিতে নাদিরা বেগম, নাট্যকলায় কাজী বোরহানউদ্দীন, আবৃত্তিতে নিখিল সেন, চারুকলায় সৈয়দ আবুল বারক আল্ভী, কন্ঠসংগীতে মিহির কুমার নন্দী। পদকপ্রাপ্তদের সম্মাননা স্বরূপ দেয়া হবে এক লক্ষ টাকা, গোল্ড মেডেল, উত্তরীয় এবং ফুলের শুভেচ্ছা। আগামী বৃহস্পতিবার, ৫ মে বিকেল ৩টায় আনুষ্ঠানিকভাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিতদের হাতে পদক তুলে দেবেন।
পদক প্রাপ্তির খবরে আনন্দ প্রকাশ করেছেন সংগীতজ্ঞ সুজেয় শ্যাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিল্পকলায় কতোটা অবদান রাখতে পেরেছি সেটা জানিনা, তবে সংগীতকে একটা কাঠামো দেয়ার চেষ্টা করছি সবসময়। স্বাধীনতার যুদ্ধে যখন সবকিছুতেই হায়েনাদের শাসন, তখনও গান করেছি মানুষের জন্য, দেশ ও মায়ের জন্য। আজ এই স্বীকৃতি অনেক অভিমানকে হালকা করেছে। দোয়া করবেন, যতদিন বাঁচি আজীবন যেন গানের সঙ্গেই বেঁচে থাকতে পারি।’
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে ‘শিল্পকলা পদক ২০১৫’ প্রদান অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল উপস্থিত থাকবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। পাশাপাশি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এমপি।
সংস্কৃতিসচিব আক্তারী মমতাজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জনাব লিয়াকত আলী লাকী।
শিল্পকলা পদক প্রদান ও আলোচনা শেষে আয়োজন করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিবলী ও নীপার পরিচালনায় রাঙিয়ে দিয়ে যাও, জন্মভূমি, স্বরঋতু শীর্ষক ৩টি সমবেত নৃত্য পরিবেশন করবে নৃত্যাঞ্চল।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলন উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জনাব লিয়াকত আলী লাকী, সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী এবং গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক এ আর মোল্লা।
এক পলকে সুজেয় শ্যাম
সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৪ মার্চ সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে। পিতা শ্রী অমরেন্দ্র চন্দ্র শ্যাম ছিলেন দি এইডেড স্কুলের শিক্ষক এবং মাতা শান্তিসুধা শ্যাম। বাড়িতে গান বাজনার পরিবেশেই বেড়ে উঠেছেন সুজেয় শ্যাম। জেঠা মশাই শ্রী নরেশ চন্দ্র শ্যাম কীর্ত্তন বাউল গানের খুব অনুরাগী ছিলেন।
বাড়িতে বছরের বেশিরভাগ সময়ই গানের আসর বসত, সেখানে সারা দেশের বিভিনড়ব অঞ্চলের কীর্ত্তন ও বাউল শিল্পীরা দিনের পর দিন সংগীত পরিবেশন করতেন। সুজেয় শ্যামও সেই ছোট বেলায় সবার সাথে গানের আসরে বসতেন জেঠিমার দেয়া ছোট মন্দিরা হাতে নিয়ে। এভাবেই খুব ছোটবেলা থেকে নিজের অজান্তেই সঙ্গীত তার সঙ্গী হয়ে উঠেছিলো। বড় বোন প্রভাতি শ্যাম একজন বেতার শিল্পী ছিলেন। তার সাহায্যও পেয়েছেন অনেক। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সংগীতের সাথেই চির জীবনের জন্য গেঁথে গেলেন সুজেয় শ্যাম। সংগীতের সাথে সখ্যতা করতে করতেই ১৯৬৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের চট্টগ্রাম রেডিওতে যোগদান করেন একজন গীটার বাদক ও ছোটদের গানের পরিচালক হিসেবে। এক সময় বড়দের অনুষ্ঠানেও সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে সুজেয় শ্যাম চট্টগ্রাম রেডিও’র চাকরি ছেড়ে ঢাকা রেডিওতে যোগদান করেন।
২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রিন্সিপাল মিউজিক প্রডিউসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন টুনাটুনি অডিও প্রতিষ্ঠানের সাথে সংগীত পরিচালক হিসেবে।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় অনেক দেশাত্মবোধক গানে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সেই সময় তিনি সংগীত-পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে’। তার অনেক জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান তখন মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘মুক্তির এই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘আহা ধন্য আমার’, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’-সহ অনেক উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী দেশাত্মবোধক গানে সুর করেছেন তিনি।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপরই তাঁর সুর করা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ বাংলার ঘরে ঘরে’ গানটি
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয় যা বাংলার ঘরে ঘরে মানুষের স্বজন-সম্ভ্রম হারানোর বেদনাকে আনন্দঅশ্র“তে পরিণত করে দেয়।
রেডিওতে কাজের সুবাদে তখন ওস্তাদ আমানত আলী, ফাতেহ আলী, ওস্তাদ শ্রী মোহন লাল দাস, মেহেদি হাসানের মতো গুণী সংগীত ব্যক্তিত্বের কাছে তিনি সংগীতের অনেক কিছু শিখেছেন। এ সময়ই ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খানের সাথে সুজেয় শ্যাম চলচ্চিত্রে ও ডকুমেন্টারিতে সুর ও সংগীত পরিচালনার কাজ শিখেন।
চট্টগ্রাম রেডিও’র চাকরি ছেড়ে ঢাকা রেডিওতে আসার পর সমর দাস, আব্দুল আহাদ, ধীর আলী, আব্দুল লতিফ প্রমুখের সংস্পর্শে এসে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন।
১৯৬৯ সালে তার সাথে পরিচয় হয় গুণী সংগীত পরিচালক রাজা হোসেনের। তখন রাজা হোসেন ও সুজেয় শ্যাম দু’জনে মিলে ‘রাজা-শ্যাম’ নাম দিয়ে ‘সূর্য গ্রহণ’ ‘সূর্য সংগ্রাম’ ‘ভুল যখন ভাঙ্গল’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে সুরারোপ ও সংগীত পরিচালনার কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি এককভাবে যেসব চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘হাসন রাজা,’ ‘জয়যাত্রা’, ‘বলবান প্রতিকার’, ‘হাতকড়া’ ইত্যাদি। তাঁর সর্বশেষ সুরারোপ ও সংগীত পরিচালনার চলচ্চিত্র ‘অবুঝ বউ’।
কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে অনেকবার বিভিনড়ব দেশেও গিয়েছেন তিনি। ভারতীয় অনেক স্বনামধন্য শিল্পী যেমন সন্ধ্যা মুখার্জী, নির্মল মিশ্র, হৈমন্তি শুক্লা, শ্যামল মিত্র, ইন্দ্রনীল, শম্পা কুণ্ডসহ আরও অনেকেই তার সংগীত পরিচালনায় গান গেয়েছেন।
১৯৭৯ সালে তিনি লাভ করেন বাসাস পুরস্কার। ২০০৩ সালে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘হাসন রাজা’।
পারিবারিক জীবনে সুজেয় শ্যাম এক কন্যা সন্তানের জনক।
এলএ/এবিএস